মা গন্ধেশ্বরী পূজা: গন্ধবণিক সমাজের কুলদেবীর পূজার আচার, ইতিহাস ও তাৎপর্য
বাঙালি হিন্দু সমাজে বিভিন্ন বর্ণ ও পেশাভিত্তিক কুলদেবী বা কুলদেবতার পূজা এক গভীর ঐতিহ্য বহন করে। এরই মাঝে অন্যতম হলো গন্ধবণিক সম্প্রদায়ের কুলদেবী – মা গন্ধেশ্বরী। মূলত বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে এই বিশেষ দেবীর আরাধনা করা হয়। তবে এই পূজা শুধুমাত্র ধর্মীয় নয়, বরং এটি একটি পেশাভিত্তিক বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।
গন্ধবণিক সমাজ: পরিচয় ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
গন্ধবণিক একটি প্রাচীন বাঙালি বণিক শ্রেণি, যাঁরা সুগন্ধি দ্রব্য যেমন – ধূপ, ধূনা, আতর, চন্দন, কেশর, কস্তুরি, গন্ধক, প্রসাধনী, ভেষজ ইত্যাদি সামগ্রীর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ফা-হিয়েনের বিবরণেও এই শ্রেণির উল্লেখ পাওয়া যায়। সমাজে তাঁদের পেশার গুরুত্ব যেমন ছিল, তেমনই তাঁদের ধর্মীয় চেতনায় শক্তির উপাসনার গভীর ছাপও ছিল।
এই সমাজের মানুষরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের জীবিকা, ঐতিহ্য এবং সমাজ রক্ষার জন্য এক বিশেষ শক্তির আবির্ভাব ঘটেছিল – যিনি পরবর্তীতে 'মা গন্ধেশ্বরী' নামে পূজিত হন।
পৌরাণিক কাহিনি: গন্ধাসুর বধ ও দেবীর আবির্ভাব
পুরাণ অনুসারে, প্রাচীনকালে গন্ধবণিকদের এক মহান সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় – এক অসুর, নাম গন্ধাসুর, যিনি গন্ধ সমাজ ও পৃথিবীর সৌরভ ধ্বংস করতে চেয়েছিল। এই অসুর থেকে রক্ষা পেতে সমাজের এক ধর্মনিষ্ঠা নারী গন্ধবতী কঠোর তপস্যা শুরু করেন।
তার হোমযজ্ঞে যখন গন্ধাসুর হামলা চালায়, তখন সেই হোমকুণ্ড থেকে আবির্ভূতা হন মা গন্ধেশ্বরী। তিনি সিংহবাহিনী, চতুর্ভুজা, ত্রিনয়নী দেবী। তাঁর হাতে শঙ্খ, চক্র, ধনুক ও বাণ। তিনি অসুরকে বধ করেন এবং গন্ধবণিক সমাজকে রক্ষা করেন।
এরপর থেকে তাঁকে কুলদেবী হিসেবে মান্য করা হয়।
গন্ধেশ্বরী ও শক্তির অন্যান্য রূপ
শাক্ত ধর্মমতে, সকল দেবী এক আদিশক্তির বিভিন্ন রূপমাত্র। মা দুর্গা, মনসা, চণ্ডী, বনদেবী, ষষ্ঠী, শীতলা – এঁরা সকলেই একই শক্তির বহু রূপ। মা গন্ধেশ্বরী সেই আদিশক্তিরই একটি বিশেষ রূপ, যিনি গন্ধবণিক সমাজে আরাধিত হন।
শ্রী শ্রী গন্ধেশ্বরী পূজা ২০২৫
পূজার নির্দিষ্ট তারিখ
-
পূজা দিবস: সোমবার
-
তারিখ (বাংলা): ২৮শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
-
তারিখ (ইংরেজি): ১২ই মে, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
এই দিনে গন্ধবণিক সমাজের কুলদেবী মা গন্ধেশ্বরী-র আরাধনা অনুষ্ঠিত হবে। পূর্ণ চৈতন্য ও ভক্তিভরে দেবীর পূজা করা হবে বৈশাখী পূর্ণিমায়। এই পুণ্যতিথিতে দেবীকে ধূপ, ধূনা, আতর, চন্দন, মধু, ফুল ও ফল নিবেদন করে পেশাগত সাফল্য ও সামাজিক কল্যাণ কামনা করা হয়।
গন্ধবণিক সম্প্রদায়ের এই পূজা শুধুমাত্র একটি কুলদেবীর পূজা নয়, এটি একটি সংস্কৃতি, একটি বিশ্বাস, একটি ঐতিহ্য এবং শক্তির আরাধনা। বৈশাখী পূর্ণিমায় এই পূজার মধ্য দিয়ে মানুষ ধ্যান করে প্রকৃতির, শক্তির, সুগন্ধের – অর্থাৎ সৌন্দর্যের।
আজকের দিনে যখন অনেকেই তাঁদের প্রাচীন শিকড় ভুলে যাচ্ছেন, তখন এই পূজা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ঐতিহ্যই আমাদের পরিচয়।
#গন্ধেশ্বরী_পূজা #গন্ধবণিক_সমাজ #বাংলার_ঐতিহ্য #শক্তিরূপা #মা_দুর্গার_রূপ #শাক্ত_ধর্ম #বৈশাখীপূর্ণিমা #গন্ধাসুর_বধ #হিন্দুধর্ম_পূজা #গন্ধেশ্বরী_পূজা_২০২৫
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন